কাল্পনিক সাইকিয়াট্রিস্ট, লজিক্যাল জেরক্স, আর কিছু প্রশ্ন!

প্রফেসর নাজিব একজন কাল্পনিক সাইকিয়াট্রিস্ট। বয়স চল্লিশ, গায়ের রঙ ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। সর্ববিষয়ে অগাধ পান্ডিত্ম্য তার। প্রফেসরের অস্তিত্বহীনতার সুবিধা হল, আমি তাকে যা-তা প্রশ্ন করতে পারি। অধিকাংশ সময় সেসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেন না, আমার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকেন। ফলহীন গুরু-সান্নিধ্যের পর আমি নিজেই বইপত্র ঘাটাঘাটি করি, উইকিপিডিয়া খুলে অল্পবিস্তর জ্ঞান আহরণ করি। এরপর প্রফেসরকে পূর্বের প্রশ্ন আরেকবার জিজ্ঞাসা করি। আশ্চর্যের বিষয় হল- তিনি তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলেন! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, -সেদিন জবাব দিতে পারলেন না কেন? -সেদিন জানতাম না, তাই পারিনি। -এখন পারছেন কেন? -কারণ এ নিয়ে বইপত্র ঘেটেছি, উইকিপিডিয়ায় পড়াশোনা করেছি। -আমিও তো তাই করেছি। আপনার উত্তর আর আমার উত্তর জেরক্স, পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। কেন? প্রফেসর রহস্যময় হাসি দিয়ে বলেন, -আপনি আর আমি আলাদা, কে বলেছে? -আলাদা নই? -না, আমি আপনার আরেকটা স্বত্বা। আপনার মন খারাপ হয়, ডিপ্রেশনে ভোগেন। তখন কাল্পনিক একটা চরিত্র তৈরি করে নেন, যার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়, যা-তা প্রশ্ন করে উত্তর নেওয়া যায়। -আপনার এই যুক্তিতে গন্ডগোল আছে। -কেন? -জীবিত মানুষের পাশাপাশি আরেকটি স্বত্ত্বা চলে আসলে আমরা তাকে সাইকোলজিক্যাল ডিজর্ডার বলি। কোন অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট কেইস হিস্ট্রি নিয়ে আমাকে স্কিজোফ্রেনিক ডায়াগনোসিস করে ফেলবে।

প্রফেসর নাজিব হাসলেন। বেনসন এন্ড হেজেসে দীর্ঘ টান দিলেন। আমি নিজে শখের বসে বেনসন খাই, আমার কাল্পনিক চরিত্রও বেনসন খাবে অতি স্বাভাবিক। আমি সিগারেটে ধীরে দীর্ঘ টান দিই, প্রফেসর নাজিব সেভাবেই টান দেন। মিরর ইমেজ। -রাজীব সাহেব! -জ্বি! -দেখুন, সাইকিয়াট্রিস্টের ডায়াগনোসিসের স্বাধীনতা আছে। তিনি যে সবসময় আপনাকে পাগল ভাববেন তা নয়। তার হাতে পাঁচটি শব্দ খেলা করবে, Introspective, Schizophrenic, Crazy, Explorer, Intellectual. আপনি যেকোন একটি হতে পারেন। -আপনার লজিক কী বলছে? পঞ্চপাণ্ডবের মাঝে আমি কোনটা? -এখন বলব না। আগে বলুন, আজ কী জানতে চান? -শিশুরা কীভাবে বড় হবে? -পরিষ্কার প্রশ্ন করুন। -একটা শিশু বড় হবার সাথে সাথে কীভাবে কঠিন জিনিসগুলোর সাথে যুদ্ধ করা শিখবে? -কঠিন জিনিস বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন? আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে, নিচের ঠোঁটে কামড় দিয়ে বললাম, -কীভাবে শিশুরা খুব ছোটবেলায় শিখে যাবে পৃথিবীর সবকিছুই অর্জন করতে বিনিময় লাগে। পাশাপাশি প্রবল বিপদের সময়ও সৎ থাকবে? -আপনি দুটো বেশ সহজ ধরণের প্রশ্ন করেছেন। আরেকদিন উত্তর দিব, আজ কিছুটা ব্যস্ত। প্রফেসর নাজিব মাথা চুলকালেন, মেয়েদের মত নিচের ঠোঁটে কামড় দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম, এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। আমাকে বই ঘাটতে হবে, কিছু সাইকিয়াট্রি জার্নাল পড়তে হবে। তিনদিন পর মধ্যরাতে প্রফেসর আমার বাসায় কলিংবেল চাপলেন। দরজা খুললাম, তিনি আমাকে দেখে সহৃদয় হাসি দিলেন। -আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। -কোন প্রশ্ন? -শিশুরা কীভাবে শিখবে, সবকিছুই বিনিময়ে অর্জন করতে হয়; পাশাপাশি সততা শিখতে হয়। আমি হেসে ফেললাম। প্রশ্নটা খুব হালকা রসিকতার ধাঁচে করেছিলাম। ভদ্রলোক এত জরুরিভাবে নিবে ভাবতে পারিনি। মধ্যরাতে শুধু উত্তর জানাতেই এসেছেন! এই প্রথম কাল্পনিক চরিত্রের প্রতি আমি প্রবল মায়া অনুভব করলাম। আমি সাগ্রহে বললাম, -উত্তর বলুন শুনি। কফি খাবেন? মীনাবাজার থেকে কফি মিনিপ্যাক এনেছিলাম৷ কয়েকটা আছে। প্রফেসর কফির ধার ধারলেন না। হড়বড় করে বলা শুরু করলেন, -ব্যাপারটা খুব সাধারণ। এই ধরুন,আপনার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। মেয়েটা যখন বলে-বাবা আজ চকলেট আনবে। তখন আপনি কী করবেন? -কী করব? -তাকে গাল এগিয়ে দিয়ে বলবেন-চুমু দাও। যতটা চুমু ততটা চকলেট। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় একব্যাগ চকলেট নিয়ে আসলেন। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা। -এটা তো সবাই করছে। এভাবে তো একটা শিশু পৃথিবীতে চলার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন হল না। -তা হল না। কিন্তু এটা এক ধরণের শিক্ষা। বাবার কাছে চকলেট পেতেও বাবার গালে চুমু দিতে হয় এটা সে শিখে ফেলল। খুব ছোট্ট ব্যাপার হলেও গুরুত্বহীন নয়। এটাই শিশুদের ক্ষেত্রে যেকোনকিছু বিনিময়ের বিপরীতে কিছু অর্জনের প্রথম শিক্ষা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, -আমার বর্তমানে কিংবা মৃত্যুর পর আমার মেয়ে কিংবা ছেলে কীভাবে একা চলা শিখে ফেলবে? -অভিভাবকের অনুপস্থিতে পরিস্থিতি সামাল দেবার ব্যাপারটা খুব ব্রড টার্ম, তবুও বলছি। আমাদের একটা কমন ভুল হল, আমরা বাচ্চাদের ভালোবাসতে গিয়ে ছোটছোট জিনিসগুলো ভুলে যাই। তার কাপড় ধুয়ে দেই। তার এটো বাসন মেজে দেই। ওয়েস্টার্নরা এটা করে না। তারা শুরু থেকেই লজিক্যালি এগোয়। -কীভাবে? -এই ধরুন, শিশুদের বললেন- রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমুলে উপহার আছে। আগামীকাল বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। খুব সহজ একটা কাজ। কিন্তু দেখবেন, মেয়ে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার ধারণা ঠিক সময়ে ঘুমুলে তার পিতা ঘুরতে যাওয়া ব্যাপারটা বিনিময় করবে। -আর? -এবার তাকে ছোট্ট একটা টার্গেট সেট করে দিন। দশদিন কিংবা এক মাসের। টার্গেটে বলা থাকবে, একমাস কনস্ট্যান্টলি খাবার পর এটো প্লেটটা তাকে মাজতে হবে। যদি সে এটো প্লেট মেজে রান্নাঘরের তাকে সাজিয়ে রাখে, তাকে তার পছন্দের একটা জামা কিনে দিবেন। ঘুম ও বাসন মাজার মত সহজ দুটো কাজ শেষ হলে তাকে নতুন টার্গেট ঠিক করে দিন। এবারও সহজ কাজ, কিন্তু টার্গেটের সময়কাল দীর্ঘ। দুই মাসের। নিজের কাপড় দুইমাস নিজহাতে ধুয়ে শুকিয়ে আয়রণ করে পরলে তাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিবেন। এরপর প্রতিদিন সকালবেলা তাকে একবার করে টার্গেটের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। অনেকটা কাজের বিনিময়ে উপহার টাইপের। সরকারের কাবিখা প্রজেক্টের মত। -এভাবে কাজ হবে? -হবে। খেয়াল করুন মেয়েটা একদিন বাসন মাজা মিস করলে উপহার পাবে না। একদিন আয়রন ছাড়া ময়লা শার্ট পরলে ছেলেটা বাইসাইকেল পাবে না। এখানেই সাইকোলজির খেলা। তার প্রতিপক্ষ উপহার নয়, সময়। তাকে সময়ের সাথে রেসিং এ নামতে হবে। একদিন একদিন করে কাউন্টডাউন শুরু হবে। দীর্ঘ দুইমাস যে ছেলে নিজের কাপড় ধুয়ে আয়রন করে পরবে, সে একটা বৃত্তে আটকা পড়ে যাবে। -কীসের বৃত্ত? -বিহ্যাভিয়ার, কমপালসিভ বিহ্যাভিয়ার। একষট্টি দিনের মাথায় সে চাইলেও নোংরা কাপড় পরতে পারবে না। আয়রণ করা কাপড় ছাড়া সে কোনো কাপড় গায়ে দিতে পারবে না। তাতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে আপনি না বললেও সে আগের কাজটা চালিয়ে যাবে। নিজের কাজ নিজে করা অপমানের নয় এটা পরিবার থেকেই শিখে ফেলবে। এটাকে কমপালসন সার্কেল বলা হয়। নিজের বৃত্তে নিজেই বন্দী।
-কিন্তু সততার ব্যাপারটা কীভাবে শেখাবেন? -এই ব্যাপারটা একটু সংবেদনশীল। তার সাথে আপনাকে গেম খেলতে হবে। তাকে মূল্যবান কিছু রাখতে দিন। সেটা বেশকিছু টাকা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দলিলও হতে পারে। এরফলে সে ভাবতে শুরু করবে- সে আসলে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ। নইলে এত মূল্যবান জিনিস তার পিতা তাকে রাখতে দিত না। একটা সময় সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। খেয়াল করবেন এই ছেলে কখনো আর লুকিয়ে কিছু নিবে না, চুরি করবে না। -আমি সততার ব্যাপারটা জানতে চাইছি। -উপরের ব্যাপারটাও আপনার উত্তর। তবে এক্ষেত্রে আরেকটা মেথড আছে। গোল্ড রিং মেথড। ছেলে কিংবা মেয়েকে একটা স্বর্ণের আংটি দিলেন। সে এটা লুকিয়ে সংরক্ষণ করবে। এরপর হুট করে তার অজান্তে আপনি সেটা সরিয়ে ফেললেন। এবার কয়েকদিন পর তাকে জিজ্ঞাসা করুন- বাবা আংটিটা দাও তো। খুব গুরুত্বপূর্ন, এখনই লাগবে। এবার তাকে খেয়াল করুন। -আপনি লজিকের বাইরে চলে যাচ্ছেন। হারানো আংটি ফেরত দিবে কীভাবে? -একদম লজিকের বাইরে যাচ্ছি না, লজিকের মেইনরোডেই আছি। এখানেই তো সততার খেলা। একটা অতিরিক্ত কথা বলি। খেলা শুরুর আগে যেমন ওয়ার্মআপ করতে হয়, আংটির খেলার আগে তার সাথে আপনি ছোটছোট ওয়ার্ম আপ করবেন। ছোট ছোট ব্যাপার ঘটিয়ে তাকে বিপদে ফেলবেন। এরপর কাউন্সেলিং করবেন। একদিন তাকে বলুন, “তুমি যদি খুন করেও আসো, আমাকে সত্য বলবে। পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ আমি, যে তোমাকে বিপদের সময় চমৎকার বুদ্ধি দিব, বিপদ থেকে টেনে তুলতে সাহায্য করব”। -আংটির ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছেন। -যাচ্ছি না। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করুন, আংটি আনতে। তাকে অভয় দিন, কোন দূর্ঘটনা ঘটলেও যেন আপনাকে নির্ভয়ে বলে। সে একসময় আপনাকে বলবে, আংটি হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছে না। এবার তাকে পাশে বসিয়ে হাসিমুখে বলুন, জীবনে নানান সময় এমন পরিস্থিতিতে পড়বে। স্বর্ণের আংটি হারিয়ে ফেলবে, তোমার মনে হবে সব শেষ। এরপর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে পালিয়ে বেড়াবে কিংবা মিথ্যা বলবে। খেয়াল রেখো, পৃথিবীতে সবকিছুর সমাধান আছে পারস্পরিক আলোচনায়। বিশ্বযুদ্ধও থেমে যায় আলোচনায়। বিপদের সাথে আলোচনা করবে। ভয়ংকরতম শত্রুর সাথেও যুদ্ধের আগে আলোচনায় নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করবে। দেখবে একটা সময় তুমি শিখে ফেলেছ বিপদকে কীভাবে সামাল দিতে হয়। তুমি স্বর্ণের আংটি খুঁজে না পেলেও নিজেকে খুঁজে পাবে। পরিস্থিতির সাথে মুখোমুখি হওয়া স্বর্ণের চাইতেও দামী। মিথ্যার আশ্রয় নিবে না। নষ্ট কাঠের উপর দামী রঙ করলে যেমন কাঠ শক্ত হয় না, মিথ্যা দিয়েও সমাধান স্থায়ী হয় না।” এরপর পকেট থেকে আংটি বের করে বলবেন, এই নাও তোমার স্বর্ণের আংটি। ছেলে হয়তো বিস্মিত হবে। যে কথাটা বাবাকে বলার আগে ভয় পেয়েছিল সেই মুহুর্তের কথা ভাববে। এটা ক্রুশিয়াল মোমেন্ট। এবার তাকে বলুন- আমি যেভাবে তোমার আংটি চুরি করে বিপদে ফেলেছি, এমন অনেকেই আসবে তোমাকে বিপদে ফেলতে। সেটা মানুষও হতে পারে। কিংবা নিজের অজান্তে নিজেই দোষী হতে পারো। খেয়াল রেখো- আমার মত বাকীরা হয়তো আংটি ফেরত দিবে না। কারণ তোমার বিপদে তার কিছুই যায় আসে না। স্বর্ণের আংটিও তোমার, হারানোর পর বিপদটাও তোমার, মুক্ত হবার দায়টাও তোমার। প্রফেসর নাজিব একটানা কথা বলে যাচ্ছেন। আমি থামিয়ে বললাম, -লজিক ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ। প্রফেসর হাসলেন। -আমি জানি, আপনার পছন্দ হয়নি। এগুলো লজিক্যাল নয়, প্রমাণিত সত্য। স্বর্ণের আংটি গেমের আগেই তাকে ছোটছোট সমস্যায় ফেলুন। এরপর তাকে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়ে দিন। আলাপ করুন। পথ দেখান। তাকে বুঝতে দিন যেকোন পরিস্থিতি সে উতরে যেতে পারবে। এটাকে ডি-সেনসিটাইজেশন বলে। ডাক্তাররা এলার্জি নির্মূল করে এভাবেই। কথাবার্তা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। অধিকাংশ কথাবার্তা কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। আমার সাদাসিধে মস্তিষ্কে জটিল তত্ত্বজ্ঞান প্রবেশ করবার মত মানসিক চাহিদা নেই। আমি কড়া ভাষায় বললাম, -এখন শেষ করি নাজিব সাহেব। আরেকদিন আড্ডা দেওয়া যাবে। প্রফেসর দ্বিধান্বিত হলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। মাথা চুলকাচ্ছেন, নিচের ঠোঁটে কামড় দিচ্ছেন। তিনি জানেন, তাকে এখন চলে যেতে হবে। আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন না। যেহেতু তিনি আমার মিরর ইমেজ, লজিক্যাল জেরক্স, তাই আমার আগ্রহ থেমে যাওয়া মানেই তার কাজকর্মও থেমে যাওয়া। আমার চেতনা ছাড়া তিনি অস্তিত্বহীন! প্রফেসরের চোখেমুখে অন্ধকার! আমি একরাশ মায়া নিয়ে তার প্রস্থানের দৃশ্য অবলোকন করছি। Egiye Cholo